Breaking

আমাদের জীবনে এমন অনেক মুহূর্ত আসে, যখন আমাদের মনে হয় আমরা আমাদের মানসিক ক্ষমতার একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছি। সামনে জীবন কোনদিকে যাবে কিছু বোঝা যাচ্ছেনা; ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই এমনি দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা সবার জীবনেই কখনো না কখনো আসে আর সেই সময়েই পরিচয় পাওয়া যায় তার শিরদাঁড়ার ক্ষমতার।

Monday, June 17, 2019

পরী


পরী আমার জীবনের একমাত্র মেয়ে বন্ধু। এর আগে স্কুল জীবন বা কলেজ জীবনে মেয়েদের সাথে খুব একটা কথা বলতাম না। তাই কোনো মেয়ে বন্ধুও হয়নি। তবে পরীর সাথে বন্ধুত্বটা হয় আমার ফেসবুকে। একদিন হঠাত করেই ফেসবুকে পরীর আই.ডি টা দেখি। কৌতুহল বসত তার আই.ডি এর ভেতর ঢুকি। মেয়েটার পোস্টগুলো পড়ে অনেক ভালো লাগে। তার প্রত্যেকটা পোস্টই তার বাবাকে ঘীরে। বুঝতে পারলাম বাবাকে অনেক ভালোবাসে সে। আমার জন্মের এক বছর পরেই আমার বাবা মারা যায়। তাই পরীর তার বাবাকে নিয়ে লেখা পোস্টগুলো দেখে তার প্রতি অনেকটা মায়া জন্মে যায়। পরীর কত সৌভাগ্য ওর পাশে ওর বাবা আছে। তারপর পরীকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাই। তিন দিন পর এক্সেপ্ট করে সে। প্রথমে আমিই তাকে নক করি। স্বভাবতই আমি কাউকে নক দিলে একটা ডট (.) দিয়ে নক দেই। পরীও তিনটা ডট (.) দ্বারা উত্তর দিলো। এই ডটের বিশেষ কোন মানে নেই। তবে বন্ধুত্ব শুরু হওয়ার জন্য এর থেকে বেশী কিছু দরকার ছিল না। পরীর সাথে অনেক সময়েই চ্যাটিং হতো। তারপর পরী আমার ভালো বন্ধু হয়ে যায়। ভালো বন্ধু থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড। তারপর মোবাইল নাম্বার আদানপ্রদান। আমরা প্রায়ই মোবাইলে কথা বলতাম। আমাদের দুজনের মধ্যে বেশিরভাগ কথাই হতো পরীর বাবাকে নিয়ে। পরী বলতো পৃথিবীতে তার ৩ টা বেস্ট ফ্রেন্ড। একজন আল্লাহ, আরেক জন তার বাবা। আর তিন নাম্বারটা নাকি আমি। তাই তার বাবা সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠা থেকে ঘুমাতে জাওয়ার আগে পর্যন্ত কি কি করতো সবই আমাকে বলতো। পরীর বাবা নাকি খুব ভালো রান্না করতে পারে। পরীকে রোজই কিছু না কিছু রান্না করে খাওয়াতো আর তার কথা পরী আমাকেই প্রথম বলে। বুঝতাম পরী মেয়েটা তার বাবার পাগল। বাবাকে অনেক ভালোবাসে। অবশ্য তার বাবাও তাকে অনেক ভালোবাসে। পরীর জন্মের পরেই তার মা মারা যায়। তারপর থেকে তার বাবাই তাকে এত্ত ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে। অনেকে নাকি তার বাবাকে আরেকটা বিয়ে করে নতুন সংসারে জাওয়ার কথা বলেছিলো। তবে সে শুধু পরীর জন্যই তাদের কথা কানে নেয়নি। তাদের বাবা-মেয়ের ভালোবাসার কথা শুনে মাঝেমধ্যে আমার একটু কষ্ট ও হিংসাও হতো আমারতো আর বাবা নেই।
.
এরপর কয়েকবার আমি আর পরী একে অপরের সাথে দেখাও করি। বেশ মিষ্টি একটা মেয়ে পরী। বাকপটুও বলা চলে। তবে পরী বেশিক্ষন আমার সাথে থাকতো না। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই চলে যেতো। বলতো তার বাবা নাকি তার জন্য চিন্তা করবে। তাকে চোখের আড়াল হতেও দেয় না।
.
তবে অনেকদিন ধরেই পরীর সাথে দেখা হয় না আমার। ওর বাবা নাকি একটু অসুস্হ্য তাই। ফোনেও কথা হয় না বেশ কিছুদিন। তবে হঠাত করেই রাত সাড়ে ৯ টায় পরীর কল আসলো। কল ধরতেই:
- হ্যালো, আলীম।
-হুম। তুই এতো রাত্রে কল দিলি। আঙ্কেল ঠিক আছে তো।
-আরে বাবার কিছূই হয়নি। তবে হবে। আগে বল এখন দেখা করতে পারবি?
-এতো রাত্রে? তোর প্লানটা কী আগে বলবি তো ।
-তুই দেখা করবি কিনা ?আগে তাই বল?
-আচ্ছা। কই তুই?
.
.
তারপর পরীর কাছ থেকে ঠিকানাটা যেনে তার সাথে দেখা করার জন্য বেরিয়ে পড়ি। তবে বেশ অবাক হই । যে মেয়ে সন্ধ্যার আগে । বাবা চিন্তা করবে বলে বাড়িতে চলে যায়। সে মেয়ে রাত দশটায় কেনো দেখা করতে চায়।
.
অনেক কষ্টে মাকে মিথ্যা কথা বলে বাড়ি থেকে বের হই। বাস থেকে নেমেই দেখি পরী রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছে। পরী আজ নীল একটা শাড়ী পড়ে অনেক সেজে এসেছে। ওকে দেখতে একদম পরীর মত লাগছিলো। কাছে গিয়েই প্রশ্ন করলাম:
-কি রে এতো রাতে ডাকলী কেন? তবে অনেক সুন্দর লাগতেছে তোরে।
-একটা কাজ আছে।
-এতো রাত্রে কী কাজ? আর তোর বাবা কিছু বলে নাই? এতো রাত্রে বাইরে বের হলি?
-বাবারে ঘুমের ঔষধ খাওয়াইয়া রেখে আসছি। ৩ ঘন্টার আগে আর ঘুম থেকে উঠবে না।
-কী! মানে কী? কেন করলি এইগুলা?
-কালকে আমার বাবার জন্মদিন। আমি আজ রাত ১২টায় ই বাবাকে সারপ্রাইজড দিবো। জানিস আমার বাবা চকলেট কেক অনেক ভালোবাসে। আমার বাবা-মায়ের লাভ ম্যারেজ ছিলো। আমার মা আর বাবা বিয়ের আগে ৬ বছর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। মা, বাবার প্রত্যেকটা জন্মদিনে চকলেট কেক দিয়ে বাবাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতো। তবে মা মারা জাওয়ার পর নাকি বাবা আর চকলেট কেক খেতো না। তবে আমি এরপর থেকে প্রত্যেক জন্মদিনে বাবাকে চকলেট কেক খাওয়াই। আজকেও একটা চকলেট কেক লাগবে।
-দূর পাগলী। এইটা আগে বলবি না। চল একটা কেক কিনে নিয়া আসি। তবে আমিও কী তোর সাথে যাবো ।
-হুম। আজ তোকে আমার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।
-ইস। আগে বলবি না । একটু সেজেগুজেই আসতাম। তোর বাবা বলে কথা।
-ইস। মনে হয় তোর শ্বশুরের সাথে দেখা করতে যাইতেছিস। তাও তোরে দেখতে এতোটাও খারাপ লাগতেছে না।
.
এরপর দুজনে মিলে গেলাম বেকারীতে। তবে দুঃখ জনক ভাবে একটা দোকানেও চকলেট কেক পেলাম নাহ। পরীর মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেলো। একটা বেকারী বললো এইখান থেকে কিছুটা দুরে একটা বড় বেকারী রয়েছে। সেখানে গেলে পাওয়া যেতে পারে চকলেট কেক। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো। তবে আমি শুধু পরীর মন খারাপ মাখা চেহারাটাই দেখতে পারছিলাম। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ঐ বেকারীতেই যাবো। অনেকটা রাত তাই পুরো রাস্তা প্রায় ফাকা। একটা রিক্সাও খুজে পেলাম না। তাই দুজনে পায়ে হেটেই রওনা দিলাম বেকারীর উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ আধাঘন্টা হাটার পরো চারিদিকে না তো কোন মানুষ, না তো কোন রিক্সা, না তো কোন ব্যাকারী দেখতে পেলাম। এইদিকে তো আমার পায়ের অবস্হ্যা শেষ। পরীর দিকে তাকিয়ে আরো হাসি পেলো। একেতো মন খারাপ তার উপর পুরাই ক্লান্ত। পরীর সাজগোজ সব নষ্ট হয়ে গেলো। পরী আমার ঽাত ধরে বললো:
-দোস্ত। মইরা যাবো।
.
রাস্তা অনেক নির্জন। হালকা হালকা বাতাস বইছিলো। আকাশে তাকিয়ে দেখলাম অনেক বড় একটা চাঁদ। আর কিছু না ভেবে। এক মুহুরতেই পরীকে কোলে তুলে হাটতে শুরু করলাম। পরী অবাক হয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমি অবশ্য অনেকটা রোমান্টিকতা বসতই পরীর দিকে আর তাকালাম না।
.
অতপর আমরা সেই বেকারীর সামনে পৌছালাম। তবে পৌছে সেই বেকারীটা বন্ধ দেখে আমাদের দুজনেরই চোখের পানি বেরিয়ে গেলো। তবে পরীর কান্না আমার সহ্য হয় না । বেকারীর ভেতরে হয়তো কেউ আছে। তাই সাটারে অনেক্ষন জোড়ে জোড়ে ধাক্কালাম, লাথি মারলাম। অবশেষে দুইটা ছেলে রেগে লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়লো। হয়তো আমাকে মারতেই আসছিলো। তবে আমি তাদের সব কথা খুলে বলি। এতোরাত্রে একটা মেয়েকে সাথে করে নিয়ে এসেছি একটা মাত্র কেক নিতে। ওরা কিছুতেই দিতে চাইছিলো না। বলছিলো পরের দিন সকালে আসতে। অতপর ৬০০ টাকার কেক ১০০০ টাকা দিয়েই কিনতে হলো।
.
এইবার চকলেট কেক পেয়ে পরীর মুখে আবার হাসি দেখতে পাই। এইবার কপালটা ভালো। রাস্তায়ই একটা রিক্সা পেয়ে যাই। রাত ১২ টা বাজতে খুব একটা দেড়ী নেই। তাই একটা রিক্সায় দুজনে উঠেই পরীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
.
পরীদের বাড়িতে পৌছালাম। বাড়িটা বেশ সুন্দর দেখতে। আজ প্রথম পরীর বাবার সাথে দেখা করবো। এর আগে তার কথা পরীর কাছ থেকে অনেক শুনেছি । তবে তার সাথে কখনো কথা বলা হয়নি। আজতো সামনাসামনি তাকে দেখবো।
.
পরী কেকটা নিয়ে দৌড়ে বাবা বাবা করে ঘরে ডুকতেছিলো। আমি তার পিছু পিছু ছুটলাম।
.
বাইরে থেকেই শুনছিলাম পরী চিতকার করে বলছে "হ্যাপি বার্থ ডে বাবা। কী হলো অবাক হয়েছোতো। দেখো তোমার জন্য তোমার প্রিয় চকলেট কেক নিয়ে এসেছি। কি দেখছো আমার দিকে এইভাবে? অনেক সুন্দর লাগতেছে আমাকে দেখতে তাই না। মায়ের মতোন লাগছে? দেখেছো মায়ের প্রিয় শাড়ীটাই পড়েছি আজ।"
.
আমি একটু আস্তে আস্তেই ঘরে ডুকলাম। ডুকে যা দেখলাম। আমিতো পুরোই অবাক। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। মনে হলো আমার আত্মা শরীর থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি ফ্লোরে বসে পড়লাম।
.
পরী কেকটা একটা ছবির সামনে রেখে সেই ছবির সাথেই কথা বলছিলো। ছবিটা দেখে বুঝতে পারলাম তার বাবার ছবিই।
.
ছবির সাথেই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে। এটা নাকি তার বাবা। বাবার ছবিকেও আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
.
তারপর ঘরে দেখলাম তার খালাও তার সাথে থাকে। তার কাছ থেকে যাহ শুনলাম শুনে আমি পুরাই বোবা হয়ে গেলাম।
"পরার মা মারা জাওয়ার পর পরীর বাবাই তাকে সব ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করেছে। পরীর পুরো পৃথিবীই ছিলো তার বাবা। পরীর বাবারো পৃথিবী বলতে ছিলো পরী। তবে আজ থেকে ৩ বছর আগে নাকি পরী আর তার বাবা একটা বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে রাতে বাড়িতে ফিরছিলো। হঠাত একটা ট্রাকের সাথে পরিদের গাড়ির সংঘর্ষ হয়। পরীর বাবা পরীকে ধাক্কা মেরে গাড়ির বাইরে বের করে দেয়। তবে নিজে আটকা পড়ে থাকে গাড়ির ভেতর। গাড়ির ভেতর থেকেই মারা যায় পরীর বাবা। পরী তার বাবাকে অনেক ভালোবাসতো। হঠাত তার চোখের সামনেই তার বাবার মৃত্যুটা পরী সহ্য করতে পারেনি। তার মস্তিষ্ক এখনো মেনে নিতে পারেনি যে তার বাবা মারা গেছে। তাই শুধু পরীই তার বাবাকে দেখতে পায়। নিজে নিজেই বাবার সাথে কথা বলে। কল্পনার রাজ্যে সাজিয়ে নেয় বাবা নামের চরিত্রটাকে। পরীর এই মানষিক সমস্যা ৩ বছর ধরে।
.
.
এইকথা গুলো শুনে আমার চোখ দিয়ে অবিরাম পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। তারমানে পরীর সাথে আমার বন্ধুত্ব এক বছরের। এই এক বছরে পরী তার বাবা সম্পর্কে যা কিছু বলেছে তা পুরোটাই ওর কল্পনা ছিলো।
.
আমি কাঁদতে কাঁদতে পরীর পাশে গিয়ে দাড়িয়ে পরীর হাসিমাখা আনন্দে বিস্মীত চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। শক্ত করে তার হাতটা ধরলাম। আর মনে মনে শপথ করলাম:
.
"তোর হাসিমাখা মুখটা দেখার জন্য আজীবনের জন্য তোর হাতটা ধরলাম। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তোর হাতটা ধরে রাখবো। না হয় তোর একটু হাসি দেখার জন্য তোর বাবাক আমিও কল্পনায় দেখে নিবো।"


No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Your Ad Spot